যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত,তারাই সফলকাম-(সুরা তাগাবুন)
ইমান২৪.কম: সুরা মুনাফিকুনের পর আমরা সুরা তাগাবুনের প্রাথমিক পরিচিতি ও এর কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সুরা তাগাবুন হচ্ছে সুরা তালাকের আগের সুরা। সুরা তাগাবুনের সপ্তম ও অষ্টম আয়াতে বলা হচ্ছে,কাফিররা মনে করত যে কিয়ামত বা পুনরুত্থানের দিন তাদের পুনরুজ্জীবন ঘটবে না। কিন্তু মহান আল্লাহ তা নাকচ করে দিয়ে বলছেন: কাফেররা দাবী করে যে,তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। হে নবী! আপনি বলুন, অবশ্যই হবে,আমার পালনকর্তার কসম, কাফির ও মুমিনরাসহ তোমরা সবাই অবশ্যই হবে পুনরুত্থিত। এরপর তোমাদেরকে জানানো হবে যা তোমরা করতে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। অতএব তোমরা আল্লাহ তাঁর রসূল এবং অবতীর্ন নূরের তথা পবিত্র কুরআনের প্রতি ঈমান আন। তোমরা যা কর,সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। সুরা তাগাবুনের নয় নম্বর আয়াতে কিয়ামত বা পুনরুত্থান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘ভেবে দেখ,সেদিন অর্থাৎ, হাশর বা সমাবেশের দিন আল্লাহ তোমাদেরকে সমবেত করবেন। এ দিন হার-জিতের দিন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে,আল্লাহ তার পাপগুলো মোচন করবেন এবং তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন যার গাছপালার তলদেশে নির্ঝরিনীগুলো প্রবাহিত হবে, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এটাই মহাসাফল্য।’
-অর্থাৎ কিয়ামত হচ্ছে বিচার দিবস তথা মানুষের ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদান পাওয়ার দিন। সেদিন কেউ কেউ হবে ভীষণ অনুতপ্ত,ক্ষতিগ্রস্ত ও মহাশাস্তির কারণে মর্মাহত ও বিপর্যস্ত। অন্যদিকে কেউ কেউ হবে বিজয়ী ও সৌভাগ্যবান। সেদিন এটা স্পষ্ট হবে যে কারা দুনিয়ার জীবনের কাজকর্মে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও কারা হয়েছে পরাজিত। সুরা তাগাবুনের দশ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: আর যারা কাফের এবং আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা বলে,তারাই জাহান্নামের অধিবাসী,তারা তথায় অনন্তকাল থাকবে। কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল এটা। সুরা তাগাবুনের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ দেখান। আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত। তোমরা আল্লাহর এবং রাসুলুল্লাহর আনুগত্য কর। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমার রাসূলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্টভাবে দাওয়াত বা আহ্বান পৌঁছে দেয়া।’ সুরা তাগাবুনের ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: হে মুমিনরা,তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের দুশমন। অতএব তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক।
যদি মার্জনা কর, উপেক্ষা কর, এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুনাময়। এর পরের আয়াতে একই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ। আর আল্লাহর কাছেই রয়েছে মহাপুরস্কার।’ সুরা তাগাবুনের ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, শুন, আনুগত্য কর এবং ব্যয় কর (আল্লাহর পথে)। এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। এবং যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম। ‘ -সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভয় করা মুমিনদের জন্য অপরিহার্য। কারণ মহান আল্লাহর ভয় মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে। আল্লাহর কথা শোনা ও তাঁর নির্দেশ মান্য করাও অপরিহার্য। মহান আল্লাহর নানা নির্দেশের মধ্যে এ নির্দেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বান্দাহ বা আল্লাহর দাসরা তাঁর পথে দান-খয়রাত করবে। এ বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য অন্যতম প্রধান পরীক্ষা। অবশ্য আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাতের কারণে মানুষ তথা আল্লাহর বান্দাহ নিজেই লাভবান হয়। এখানে এটাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে যারা কার্পণ্য ও লোভ এড়িয়ে চলতে পারে তারাই সফল। মানুষের সফলতার পথে দুই প্রধান বাধা হল কার্পণ্য ও লোভ।
যারা এ দুই মানসিক রোগ থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করতে পারে তাদের সৌভাগ্য অনিবার্য। হযরত ইমাম সাদিক (আ) সম্পর্কে এক বর্ণনায় দেখা গেছে তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাবা ঘরের চারপাশে প্রদক্ষিণ তথা তাওয়াফ করছিলেন এবং এ সময় তিনি একনাগাড়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে বলছিলেন: হে আল্লাহ আমাকে মন তথা নাফস বা প্রবৃত্তির কার্পণ্য থেকে রক্ষা করুন। তাঁকে প্রশ্ন করা হল: কেনো সব সময় এই দোয়া করছেন? উত্তরে তিনি বলেন: মনের লোভ ও কার্পন্য থেকে বড় বিপদ আর কি হতে পারে? এরপর তিনি সুরা তাগাবুনের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন যেখানে বলা হয়েছে: ‘এবং যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত,তারাই সফলকাম।’
দানে উৎসাহ দেখিয়ে সুরা তাগাবুনের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তিনি তোমাদের জন্যে তা দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ শোকরগুজার বা গুণগ্রাহী ও সহনশীল।’-পবিত্র কুরআনে বার বার এ জাতীয় বর্ণনা দেখা গেছে যেখানে মহান আল্লাহকে কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব-জগত তথা অস্তিত্ব জগতের স্রস্টা। সব নেয়ামত ও সৃষ্টিকুলের মালিক তিনি। অথচ তিনি আমাদের কাঝে ঋণ চাইছেন! এবং এ ঋণের বিনিময়ে আরও বেশি প্রতিদান দেয়ার ও ক্ষমা করার এবং কৃতজ্ঞতার ঘোষণা দিচ্ছেন। আসলে আল্লাহ তো কোনো কিছুরই মুখাপেক্ষী নন।
বরং আমাদেরকে করুণা করতে তিনি নিজ সম্পদ থেকেই ঋণ চাইছেন। এটা মুমিনদের প্রতি তাঁর অশেষ ভালবাসার প্রকাশ। আমাদের কাছে কি আছে বা আমরা কিসের মালিক যে মহান আল্লাহকে ঋণ দেব? আর কিসের বিনিময়ে আমরা এতসব মহাপুরস্কার পাব? – আসলে এসবই হচ্ছে দানের মহাগুরুত্ব এবং বান্দাহদের প্রতি মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও করুণারই প্রকাশ।