জলাবদ্ধতা হলে আগে টাখনু ডুবত, ভবিষ্যতে কোমর ডুববে
ইমান২৪.কম: ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হলেই রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। এতে করে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীর। অনেক সড়কে হাঁটু সমান পানিতে যান চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এতে করে কর্মমুখী মানুষকে সব থেকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ বছর জলাবদ্ধতা এতটাই তীব্র যে, জলাবন্ধতার কারণে থমকে যাচ্ছে রাজধানী। বিশেষ করে অবিরাম বর্ষণের ফলে রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, রাজারবাগসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও অলিগলির রাস্তা যান চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
একটু ভারী বর্ষণ হলেই এসব এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবন্দি থাকতে হয় কয়েক ঘণ্টা। জলাবদ্ধতার ভুক্তভোগী শাহরিমা আকতার লিজা নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, দীর্ঘ সাত বছর মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকি। সেখান থেকেই কর্মস্থল কলাবাগানে যাই নিয়মিত। কিন্তু বৃষ্টি হলে সেদিন ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার সড়ক যেন নদীতে পরিণত। প্রচণ্ড জ্যাম তৈরি হয়, সময় মতো কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারি না। ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হলেই রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ সড়ক পানিতে তলিয়ে যায় মিরপুরের বাসিন্দা সরকারি কর্মকর্তা শাহ আলম বিপ্লব একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ভারী বর্ষণে মিরপুর ১০ নম্বরসহ পুরো এলাকার রাস্তা পানিতে ডুবে যায়। মিরপুর দুই থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত খুবই খারাপ অবস্থা। জলাবদ্ধতায় গাড়ি নষ্ট হয়ে রাস্তায় আটকে থাকে।
অল্প কিছুদিন আগে মিরপুরের কিছু জায়গায় ড্রেনের কাজ হয়েছে। কিছু জায়গায় কাজ চলমান। ফলে আরো সমস্যা হচ্ছে। সব মিলিয়ে খুবই বাজে অবস্থা। কর্মস্থল গুলশান হওয়ায় নিয়মিত বনানী হয়ে যাতায়াত করি। বনানীতে ঢোকার মুখে ও নৌবাহিনীর সদর দফতরের সামনের সড়কও পানিতে টইটুম্বুর থাকে। ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ খোন্দকার এম আনসার হোসেন বলেন, মূলত চার কারণে ঢাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো, তাৎক্ষণিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নাই। আমাদের সড়কে যেসব সুড়ঙ্গ মতো জায়গা রয়েছে বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সেগুলো খুবই ছোট এবং পাইপ সিস্টেম হওয়ায় সেগুলো দিয়ে পর্যাপ্ত পানি নির্গত হতে পারে না।
এছাড়া এসব সুড়ঙ্গের মুখে ভেন্টিলেটরের মতো লোহার খাঁচা দিয়ে দেয়ায় সেগুলোতে ময়লা আটকে থাকায় পানি যেতে বাধা সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে দয়াগঞ্জ সড়ক রাজধানী নিচু জায়গা না থাকেও জলবদ্ধতার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরদিকে নগরে বৃষ্টির পানি আশ্রয়ের মতো অব্যবহৃত নিচু জায়গা বা পুকুর না থাকাও একটা কারণ। এক সময় ঢাকার আবাসিক এলাকায় বসতবাড়ির পাশাপাশি পুকুরের মতো কিছু নিচু জায়গা ছিলো। সেসব জায়গায় বৃষ্টির পানি তাৎক্ষণিক আশ্রয় পেত। পরে জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে বা মাটির টানে পানি শুকিয়ে যেত। এখন সেই ব্যবস্থা না থাকায় দ্রুতই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
যদিও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পঞ্চাশ একর আবাসিক এলাকায় ছয় একর ছোট ছোট পুকুর রাখতে হবে। কিন্তু এসব নিয়ম শুধু খাতা কলমেই আছে বাস্তবে প্রয়োগ নেই। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, ঢাকা অতিদ্রুত নগরায়ণের ফলে বৃষ্টির পানির সব অংশই নর্দমা ও প্রাকৃতিক খালের মধ্যে যাচ্ছে। এতে করে নির্মাণ বর্জ্যও পানির সাথে ড্রেন হয়ে খালে গিয়ে পড়ছে। কাদার সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে মাটির নিচে তেমন পানির প্রবাহ যেতে পারছে না। তাই পানি জমে থাকায় নতুন পানি আশ্রয়ের জায়গা পাচ্ছে না- যোগ করেন আনসার আলী। সব থেকে বড় দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও খালের মাধ্যমে নগর থেকে পানি বের হয়ে নগরের বাহিরে যে স্থায়ী খালগুলোতে আশ্রয় নেবে সেগুলো দখল ও ভরাট করে আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। এতে নগর থেকে পানি নির্গত হওয়ার স্থায়ী কোন জায়গা পাচ্ছে না। কালশি খাল, বাড্ডার পেছনের বড় খাল ও পূর্বাচল এলাকার বড় বড় খালগুলো ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরি করায় নগরের আশেপাশে কোন নিচু জায়গা থাকছে না।
জলাবদ্ধতা এসব সমস্যার আশু সমাধান করতে না পারলে ভবিষ্যতে ঢাকাবাসীকে কি ধরণের ভোগান্তি পোহাতে হবে? জানতে চাইলে এই নগরবিদ বলেন, বছর কয়েক আগে জলাবদ্ধতা হলে পায়ের টাখনু ডুবত আর এখন হাঁটু ডোবে। সমস্যার সমাধান না হলে কোমর ডুববে। গতবছর ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার থেকে ঢাকা দক্ষিণ এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে হস্তান্তর করা হয়। দায়িত্ব পেয়ে বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি খালগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন দুই মেয়রই। তবে তাদের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নগরবাসীর মনে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের এখন পর্যন্ত সফল হতে পারেননি বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ নগরপিতারা। গত ২২ জুন জলাবদ্ধতা নিরসন বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সবার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই প্রবল বৃষ্টিপাতেও নগরবাসীকে জলজটের ভোগান্তি থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য বছর সামান্য বৃষ্টিতেই বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট ডুবে যেতো। এবার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতেও নগরবাসীকে জলজট সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে না। গত ১ জুন ঢাকায় রেকর্ড ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নগরবাসীকে জলজট থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।