কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্র কেনার নামে ২১ কোটি টাকা চুরি হয়েছে

ইমান২৪.কম: কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্র কেনার নামে রীতিমতো পুকুর চুরি হয়েছে। চুরি আর অনিয়মের মাত্রা এতই বেপরোয়া যে- শুনলে যে কারোরই চোখ কপালে উঠবে! মেডিকেল কলেজটির আসবাব কেনার নামে প্রায় ২১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে এই পুকুর চুরির বন্দোবস্ত করা হয়। দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এমনকি কেনাকাটায় চরম অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও নিয়মবহির্ভুতভাবে ঠিকাদারকে বিল পাইয়ে দিতে নানান রকমের জাল-জালিয়াতি করেছে দুর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেট। জানা যায়, এসব মালামাল কিনতে নামমাত্র দরপত্র আহ্বান করা হলেও কার্যত কোনো প্রতিযোগিতাই হয়নি। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এস এল ট্রেডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এই আসবাব সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়। এ

মনকি কী পরিমাণ আসবাব লাগবে, সে বিষয়ে দরপত্র নির্বাচন কমিটির কাছ থেকে কোনো চাহিদাপত্রও নেয়া হয়নি। ফলে মেডিকেল কলেজে যে পরিমাণ আসবাব দরকার তার চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় দুই গুণ সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। তবে সরবরাহকৃত প্রায় আড়াই হাজার আসবাব একেবারেই নি¤œমানের। যার প্রত্যেকটিই কেনা হয়েছে অস্বাভাবিক দামে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব আসবাবপত্র কোথায় ব্যবহার করা হবে তার জায়গা পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এদিকে নি¤œমানের এই আসবাব দিয়ে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বিল তুলে নিতে তুলকালাম কা- ঘটিয়েছে ঠিকাদারসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ চক্রটি। অবাক ব্যাপার হলো, মন্ত্রণালয়ের তদন্তে আসবাবপত্র ক্রয়ের এই ঘটনায় ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ার পরও ভাগ-বাটোয়ারা করে এই বিল তুলে নিতে চেয়েছিল সিন্ডিকেটটি। এমনকি এ খাতে অর্থ বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ (জিও) জারির মতো অপকর্মও করেছে এই সিন্ডিকেটটি।

যেভাবে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে কেনাকাটা হলো নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো কেনাকাটায় টেন্ডার করতে হলে তারজন্য প্রথমেই দেখতে হয় বাজেটে সেই খাতে অর্থ বরাদ্দ আছে কিনা। ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কেনাকাটার জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ক্যাটাগরি অনুযায়ী মন্ত্রণালয় অথবা অধিদফতর থেকে এ ধরনের কেনাকাটায় অর্থ বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়। প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ টেন্ডার আহ্বান করবে। টেন্ডারের ক্রয়াদেশ এবং মালামাল বুঝে পাওয়ার পর ব্যয় মঞ্জুরি নিতে হয়। এরপর বিল পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জানা গেছে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের আসবাবপত্র কেনার জন্য ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে অর্থ বরাদ্দের জন্য লেখা হয়েছিল। কিন্তু, এই খাতে কোনো বাজেট না থাকায় অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি।

তারপরও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম টেন্ডার আহ্বান করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর বা মন্ত্রণালয়- কারো কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই অর্থাৎ প্রশাসনিক অনুমোদন না নিয়েই তিনি নিজের একতরফা সিদ্ধান্তে টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডারটি আসলে ওপেন টেন্ডার হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে এটি ছিল ঘুপছি বা লোক দেখানো। মিঞা ছাদুল্লাহ বিন হাসান এর মালিকানাধীন এস এল ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে আসছিল। তাই দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মিঞা ছাদুল্লাহর সঙ্গে যোগসাজশে সরকারি অর্থ লুটপাট করতেই প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া নিয়মবহির্ভূত এ টেন্ডার আহ্বান করেন অধ্যক্ষ।

ওই টেন্ডারে এমন অদ্ভূত শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, অর্থ বরাদ্দ সাপেক্ষে বিল পরিশোধ করা হবে। মিঞা ছাদুল্লাহকে সেভাবেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়। যেভাবে প্রকাশ্যে এলো অনিয়ম, দুর্নীতির তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ একক সিদ্ধান্তে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এস এল ট্রেডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে আসবাবপত্র সরবরাহের কার্যাদেশ দেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ রেজাউল করিম। এমনকি কী পরিমাণ আসবাব লাগবে, সে বিষয়ে তিনি দরপত্র নির্বাচন কমিটির কাছ থেকে কোনো চাহিদাপত্র নেননি। আর এসব অনিয়মের পথ ধরেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৩১ ধরনের ২ হাজার ৪২২টি আসবাব সরবরাহ করার সুযোগ পেয়েছে।

যার অর্ধেকই কলেজের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব সিরাজুল ইসলাম ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেডিকেল কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পান, বিভিন্ন কক্ষ ও হলে প্রয়োজনীয় আসবাব বসানোর পর অবশিষ্ট আসবাব একাধিক কক্ষে স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। অনিয়মের আঁচ পেয়ে তিনি ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

আরও পড়ুন: 

ফেসবুকে লাইক দিন