আমাদের দুই সেরা রত্ন
মাওলানা আমিনুল ইসলাম: মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী সাহেব এবং মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী সাহেব দুই জনই আমাদের আলেম সমাজের সম্পদ। প্রত্যেকেই তারা নিজ নিজ স্থানে শ্রেষ্ঠ। ওলীপুরী সাহেব একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, মুনাজিরে জামান, ওলামায়ে হকের তরজুমান। তিনি যে কত উঁচু স্তরের মানুষ, আমাদের হাফিজুর ভাই শত চেষ্টা করেও তিনি সেই স্থানে যেতে পারবেন না।
আবার হাফিজুর রহমান কুয়াকাটা বর্তমান বাংলাদেশে এবং বিশ্বের বাংলা ভাষী মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। তাঁর সুরের মূর্ছনায় লক্ষ লক্ষ যুবকের প্রাণ কেড়ে নেয়। হাফিজুর রহমান সাহেব আবার যে মাকাম তৈরী করেছেন, সেই মাকামে কিন্তু ওলীপুরী হুজুর যেতে পারবেন বলে বিশ্বাস হয় না।
মানে দুইজনই নিজ নিজ জায়গায় শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায়। ওলীপুরী সাহেব হলেন আলেম এবং তালেবুল ইলমদের উস্তাদ। তিনি কোথাও ওয়াজ করতে গেলে দেখা যায় আলেম আর মাদ্রাসার ছাত্রদের ভিড়। মাহফিলে শতকরা আশিজনই আলেম- উলামা এবং মাদ্রাসার শিক্ষিতরা উপস্থিত হন। ওলীপুরী সাহেব যে বয়ানগুলো করেন, সবই দলিল ভিত্তিক, ফেরাকে বাতেলার দাঁত ভাঙ্গা জওয়াব। কুরআন -হাদীস, ইজমা কেয়াসের মাধ্যমে বাতিল পন্থীদের তিনি জওয়াব দিয়ে থাকেন।
ওলীপুরী হুজুরের বয়ান গুলো দরসের মত। তিনি মঞ্চে উঠে দরস দেন আলেম এবং তালেবুল ইলমদের। এজন্য ওলীপুরী সাহেবের বয়ান শুনলে প্রত্যেক স্রোতার জেহেনের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। অনেক খানি বদলে যায় আগত স্রোতারা।
আর হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের বয়ান আরেক স্টাইলের। ফার্সিতে একটা কথা আছে, ‘হর ফুলেরা রঙ্গে বুয়াদ দিগারাস্ত’ একেক ফুলের একেকে ঘ্রাণ। ওলীপুরী এক ফুল, তাঁর এক ধরনের ঘ্রাণ, আর হাফিজুর রহমান এক ফুল, তাঁর আরেক ঘ্রাণ।
হাফিজুর রহমান সাহেব লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছেন তাঁর সুরের ঝলক দিয়ে। আল্লাহ প্রদত্ত এমন কণ্ঠের অধিকারী তিনি, যে কণ্ঠে মাতুয়ারা এখন দেশ বিদেশের মানুষ। তিনি যেখানেই মাহফিল করেন , সেখানেই লাখো জনতার উপস্থিতি। দিন আর রাত বলে কথা নেই। শীত আর গ্রীষ্ম নেই। হাফিজুর রহমান সাহেবের মাহফিলে মানুষকে জায়গা দেওয়া যায় না।
তাঁর মাহফিলের বড় বৈশিষ্ট্য হল, সব ধরনের স্রোতা হাজির হয়। কোন দল মত নেই। কোন তরিকা বলে কথা নেই। সব ধরনের মানুষই হাফিজুর রহমান সাহেবের মাহফিলের স্রোতা।
মাইজভান্ডার বলেন, আটরশি, দেওয়ানবাগী, কতুববাগী, জামাতী, বিএনপি, আওয়ামীলীগ, জাতীয় পার্টি, সকল তরিকার মানুষ গিয়ে হাজির হয় হাফিজুর রহমান সাহেবের মাহফিলে। সব ভেদাভেদ ভুলে যায়। তাঁর ওয়াজে এমন আকর্ষণ, সর্ব শ্রেণির লোক পাগল। বিশেষ করে, যুবক শ্রেণি, ইয়াবাখোর, গাঁজাখোর, মদখোর, সবাই যেন তাঁর ওয়াজের পাগল।
দক্ষিণ বঙ্গের একজন বিশিষ্ট আলেমদ্বীন এবং পীর, তাঁর মাদ্রাসায় প্রতিবছর হাফিজুর সাহেব বয়ান করেন। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, জনাব, আপনি কেন হাফিজুর কে প্রতিবছর দাওয়াত করেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, হাফিজুর রহমান সাহেবের মাহফিলে যেভাবে সর্বস্তরের মানুষ একত্র হয়, এরকম আর কোন বক্তার মাহফিলে পাওয়া যায় না। মানে ওয়াজ যাদের শোনানো দরকার, সেই লোক গুলো এসে পড়ে হাফিজুর সাহেবের মাহফিলে। আমরা হুজুররা তো ওয়াজ জানি, কিন্তু ঐ যে লোকগুলো, যারা একদম বরবাদ হয়ে আছে, ওরা কোন ওয়াজে যায় না। কিন্তু কুয়াকাটার হাফিজুর রহমান সাহেবের নাম শুনলে সেখানে হাজির হয়ে যায়।
ওয়াজের এই ময়দানে এক সময় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সাঈদী সাহেবের। তিনি তো জামাতী বক্তা ছিলেন। তবুও বড় গ্যাদারিং হত সেখানে। এরপর বেদাতী বক্তা তোফাজ্জল সাহেবের কিছুদিন আধিপত্য বিরাজ করেছে। আমাদের ওলামায়ে হকের তরজুমান হিসেবে সেরকম কেউ ময়দান দখল করতে পারেননি।
আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানীতে হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী সাহেব ওলামায়ে হকের তরজুমান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে লা মাজহাবী ও বেদআতী দের বিরুদ্ধে কঠোর তিনি।
হাফিজুর রহমান সাহেব হকপন্থী একজন আলেম এবং বক্তা তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর বয়ানগুলো মার্জিত। কোন বেঁফাস কথা বার্তা বা অশ্লীলতা নেই। একদম ভদ্র, নরম, সহজ সরল তিনি। নিরহংকার মানুষ। অহমিকা বলতে কিঝু নেই।
মোটকথা, ওলীপুরী সাহেব এবং হাফিজুর রহমান সাহেব দুজনই তারা নিজ নিজ বলয়ে সেরা। নিজ নিজ অবস্থানে শ্রেষ্ঠ।
এখন কথা হল, ওয়াজে চুক্তি করে টাকা নেওয়া প্রসঙ্গ। হাফিজুর রহমান সাহেব মাহফিলে হাজার হাজার জনতার মাঝে কুরআন হাতে নিয়ে শপথ করেছেন, তিনি চুক্তি করে টাকা নেন না। এই বিষয়টা আমি নিজে তাহকিক করেছি, আসলে তিনি কখনো কারো সাথে চুক্তি করেন না। মানুষ যা হাদিয়া দেয় সেটার উপরে সন্তুষ্ট থাকেন। আর তিনি যেহেতু কুরআন হাতে নিয়ে শপথ করেছেন, এ নিয়ে আর কথা বলা ঠিক না।
এখন বাদ থাকল, গলাকাটা প্রসঙ্গ। ওয়াজ করতে গিয়ে জনতার গলাকেটে টাকা নিয়ে আসেন। মানে বেশী পরিমাণ হাদিয়া নিয়ে আসেন।
আসলে এ বিষয়টা স্পর্শকাতর। কাকে ধরব আর কাকে ছাড়ব। এই রোগে এক হাফিজুর বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
গলাকাটা বক্তা নিয়ে যারা বেশী লাফালাফি করছেন, তারা কি এর বাইরে? কেউ কি বলতে পারবেন? সবাই কিন্তু এর সাথে জড়িত। কম আর বেশী। ডাইরেক্ট আর ইনডাইরেক্ট।
আজ যারা গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁদের জীবনের ফিরিস্তি টেনে দেখুন! কত গলদ ঘর্ম হয় তাদের হাজির করতে। হ্যাঁ, কেউ সহজ সরল আর কেউ চালাক। কেউ একটু লাজ- স্মরমের মাথা খেয়ে ফেলেছেন, আর কেউ একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেন।
আমরা অনেক অনেক মাহফিলে আয়োজক। প্রতিবছরই ডজন খানেক মাহফিলের ইন্তেজাম করি। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল বক্তাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছি। কার কি রকম আচরণ, কে কিভাবে হাদিয়া নেন, সবই জানা আমাদের।সে গুলো আর জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চাইনা।
তবে অনেকেই এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করেছেন, যেটা খুবই দুঃখজনক। যে কৌশল আর পদ্ধতির শিকার আমরা সাধারণ মানুষ। সেই নয়া কৌশলে গলা কাটা হয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না কেউ।
যাইহোক, পরিশেষে বিনীত অনুরোধ, আমরা ধৈর্যশীল হই। নিজেরা নিজেরা কাঁদা ছোড়াছুড়ি করা থেকে বিরত থাকি। আমাদের ওলামায়ে কেরাম সবই আমাদের অমূল্য সম্পদ। সবাই আমাদের নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকল আলেম সমাজকে কবুল করুন।
লেখক : শিক্ষক